জেলা কর্মিসভাসহ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করছে বিএনপি। এর পেছনে ক্ষমতাসীনদের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করে দলটি। বিএনপি যাতে মাঠপর্যায়ে উজ্জীবিত হতে না পারে, সেজন্য তারা পর্দার আড়ালে নানা কৌশলে এ অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপির কিছু নেতা সরকারের এ ফাঁদে পা দিয়েছেন। নিজের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় তারা এসব করছেন বলে দলটির কয়েক সিনিয়র নেতা যুগান্তরকে জানান। তবে তারা মনে করেন, এভাবে ক্ষমতাসীনরা আর বেশি দূর এগোতে পারবে না। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিএনপি পূর্ণ শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হবে এবং দলীয় এসব কোন্দলও থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ও চট্টগ্রাম বিএনপির কেন্দ্রীয় টিম প্রধান ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অনেক জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধায় কর্মিসভা পণ্ড হয়েছে। কোথাও কোথায় অনুমতিও দেয়া হয়নি। তারপরও অনেক স্থানে সফলভাবে কর্মিসভা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও বিএনপির লাখ লাখ সাধারণ ভোটার অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলের শৃঙ্খলাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড। এজন্য কেন্দ্র থেকে সবকিছুই করা হবে। কেউ সরকারের ফাঁদে পা দিয়ে অঘটন ঘটালে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দলটির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সারা দেশে কর্মিসভা শুরুর পর থেকে তৃণমূল উজ্জীবিত হতে শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতিতে এসব কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মামলা-হামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীরা এখন প্রকাশ্যে দলীয় কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। সাধারণ ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন কেন্দ্রের বার্তা। এককথায়, কর্মিসভাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি ক্ষমতাসীনরা। মাঠপর্যায়ে বিএনপি যাতে ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় হতে না পারে, সেজন্য নানা ফাঁদ পাতা হচ্ছে। বিএনপির কর্মিসভা পণ্ড করতে কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে, কোথাও আবার নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কর্মিসভা বানচাল করা হচ্ছে। কোথাও অনুমতিই দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দল বিএনপির কিছু সুবিধাবাদী নেতাকেও ব্যবহার করছে। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে তারা ক্ষমতাসীনদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন। ফলে তাদের ইন্ধনে কোথাও কোথাও কর্মিসভায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে নেতাদের পদ-পদবি ও আধিপত্য রক্ষার স্বার্থের দ্বন্দ্বেও মারামারির ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে এরই মধ্যে মাদারীপুর, পিরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কর্মিসভা পণ্ড হয়ে যায়। অথচ দলের যেসব নেতাকর্মী কর্মিসভায় হামলা চালিয়েছেন রহস্যজনকভাবে তাদের পুলিশ আটক করেনি। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করে জানা যায়, এসব নেতাকর্মী গোপনে সরকারের এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। তাদের অ্যাসাইনেমন্ট ছিল, গোলযোগ সৃষ্টি করে কর্মিসভা পণ্ড করে দেয়া।
সূত্র জানায়, এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে এসব সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যাদের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যারা সরকারের এসব ফাঁদে পা দেবেন, তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কঠোর ও কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হবে। মোদ্দাকথা- এদের দল থেকে বের করে দেয়া হবে। জানা গেছে, হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির কর্মিসভা পণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতাকে বহিষ্কার ও কেন্দ্রীয় বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিরাজমান দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় সতর্ক করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে। সোমবার রাতে সিনিয়র নেতা ও চট্টগ্রাম জেলা নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর হাইকমান্ড এমন সিদ্ধান্ত নেয়। শিগগিরই চিঠি দিয়ে তাদের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। সূত্র জানায়, কোন্দল এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সোমবার রাতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাউকে কোনো ছাড় না দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। হাইকমান্ডের এমন কঠোর বার্তা আনুষ্ঠানিকভাবে সব স্তরের নেতাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি যেসব জেলায় কর্মিসভায় বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বা যেখানে কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে- ওই জেলা নেতাদের তলব করা হচ্ছে ঢাকায়। সোমবার রাতে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলা নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। উপস্থিত নেতাদের কাছে সেখানকার কর্মিসভা পণ্ডের কারণ জানতে চান। ওই বৈঠকে চট্টগ্রামের নেতারা একে অপরকে দায়ী করে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন উপস্থিত নেতাদের ভর্ৎসনা করেন। দায়ী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। এরপর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। সেখানে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত চট্টগ্রাম উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব কাজী আবদুল্লাহ আল হাসান ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি গাজী শাহজাহান জুয়েলকে বহিষ্কার ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরীকে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে এ কর্মিসভা সফল করতে ব্যর্থ হওয়ায় সতর্ক করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমকে। জানতে চাইলে সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান যুগান্তরকে বলেন, দলের শৃঙ্খলা বা সাংগঠনিক কার্যক্রমে কেউ যদি ক্ষতি করে তাহলে কোনো ছাড় পাবে না, সে যত বড় নেতাই হোক। চেয়ারপারসন এমন বার্তাটিই দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও তৃণমূল পুনর্গঠনের প্রধান সমন্বয়ক মো. শাহজাহান বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মিসভায় যারা বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ কারণে হয়ত ৪-৫টি জেলায় সামান্য ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ রাজশাহী জেলা ও মহানগরে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও শেষপর্যন্ত ভালোভাবে কর্মিসভা সম্পন্ন হয়েছে। তবে কোথাও যদি কর্মিসভা পণ্ডের জন্য দলের নেতারা দায়ী বলে প্রমাণিত হন, সেক্ষেত্রে জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার কারণে অনেক জায়গায় কর্মিসভা করা সম্ভব হয়নি।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।