২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬


শিরোনাম
  ●  মাকে হত্যার পর থানায় ছেলের আত্মসমর্পণ।   ●  মারমেইড বীচ রিসোর্টে বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান   ●  যারা খেলাধূলা করছে, তারা বিএনপির শক্তিকে অনুধাবন করতে পারছে না   ●  উখিয়ার নতুন ইউএনও কামরুল হাসান চৌধুরী   ●  উখিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে শক্তিশালী গ্রেনেড উদ্ধার   ●  ছয় কোটি তরুণের দেয়াল লিখন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান   ●  চকরিয়ায় ২টি ডাম্পার ট্রাক ও এক্সকেভেটর জব্দ   ●  ধরে নিয়ে যাওয়া ২০ বাংলাদেশী  জেলেকে ফেরত দিল আরাকান আর্মি   ●  মেরিন ড্রাইভে ইয়াবাসহ নারী আটক   ●  সড়ক দখল করে নৈরাজ্য সৃষ্টি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়ার অভিযোগে কক্সবাজারে আ.লীগের ৯১ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

সাগরপথে মানব পাচারে শক্তিশালী সিন্ডিকেট দেশে সক্রিয় তিনশ’ দালাল

১38
 মানব পাচারের সঙ্গে এ দেশের তিন শতাধিক দালাল যুক্ত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা এসব দালালকে নিয়ন্ত্রণ করে কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রভাবশালী ২০ ব্যক্তি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটের সদর দপ্তর হচ্ছে থাইল্যান্ডে। মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায় রয়েছে এই চক্রের অনেক সদস্য। সিন্ডিকেট সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। তারা সমুদ্রগামী জাহাজ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গভীর সাগরে অবস্থান করে। ছোট ইঞ্জিন বোটে করে যাত্রীদের মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে এ জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারকারীদের আস্তানায়। এরপর মুক্তিপণ আদায়ের জন্য চলে তাদের ওপর নির্যাতন। যারা মুক্তিপণ দিতে পারে তাদের মধ্যে কারও ভাগ্য প্রসন্ন হলে
মালয়েশিয়ায় পেঁৗছতে পারে। অনেককে দাস হিসেবেও বিক্রি করা হয়। যারা দুর্ভাগা তাদের জোটে নির্যাতন। যার পরিণতি মৃত্যু। তাদের জায়গা হয় থাইল্যান্ডের দুর্গম জঙ্গলে বা কোনো পাহাড়ের গণকবরে। পাচার হয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় কক্সবাজারের উখিয়ায় গত তিন বছরে নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে দালালসহ পাঁচ শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করেছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে, সমুদ্র উপকূল দিয়ে মানব পাচারে দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক দালাল সক্রিয় রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে আটক হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের সক্রিয় হয়েছে এ পেশায়। কেউ একাধিক মামলা নিয়ে পলাতক থেকেও আদম পাচারে জড়িত।
উখিয়া ও টেকনাফ উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া মানব পাচারকালে গত চার মাসে নৌকাসহ আটক হয়েছে ছয় শতাধিক ব্যক্তি। এসব ঘটনায় আসামি করা হয় দালাল চক্রের সদস্য টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নুর হোছন, মো. নাগু, টেকনাফের নাজিরপাড়ার কামাল, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদ, মো. ফারুক, জোবাইর হোসেন, কক্সবাজার কালুর দোকান এলাকার রোহিঙ্গা মনজুর আহম্মদ, কাশেম, আবুল কালাম, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী চিরারটেক গ্রামের মো. আজিম, উখিয়ার রূপপতি গ্রামের জমির মিয়া এবং গফুর মিয়াকে। তাদের কেউ এখনও গ্রেফতার হয়নি।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আদম পাচার মামলায় আসামি করা হয় দালাল চক্রের সদস্য উখিয়ার জালিয়াপালং ডেইলপাড়া গ্রামের আবু তাহের, জসিম উদ্দিন, রফিক উল্লাহ, রহমত উল্লাহ এবং কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা রবিউল আলমকে। তারাও এখন বহাল তবিয়তে আদম পাচারে জড়িত রয়েছে।
একাধিক মামলার আসামি হয়েও দালাল চক্রের আরও যেসব সদস্য নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে_ উখিয়ার পশ্চিম সোনারপাড়া গ্রামের জালাল উদ্দিন, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের ছৈয়দ আমিন, হামিদ হোসেন, আরিফ উল্লাহ, ছৈয়দ কাশেম, রশিদ উল্লাহ, টেকনাফের শাপলাপুর পুরানপাড়ার আশিক উল্যাহ, শহীদুল্লাহ, শফি উল্লাহ, উখিয়ার সোনারপাড়া গ্রামের নুরুল কবির, তার ছেলে নুরুল আবছার, সোনাইছড়ি গ্রামের মো. সোলতান, তার ছেলে জিয়াউল হক, শফি আলম, মনখালী গ্রামের মোহাম্মদ হোছন, আব্দু রাজ্জাক, মো. ফয়সাল ও মোহাম্মদ হোছনসহ আরও অনেকে।
আটক ব্যক্তিদের তথ্যমতে, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বড়ডেইল গ্রামের রশিদ আহমদ, সদর ইউনিয়নের জাহালিয়াপাড়া গ্রামের ইব্রাহীম, বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর গ্রামের আবদুল মজিদ এবং কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার আবু ইউসুফ মালয়েশিয়ায় লোক পাচারে দালাল হিসেবে কাজ করে। তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কক্সবাজারের শীর্ষ মানব পাচারকারী উখিয়ার রেজিয়া আকতার রেবি ওরফে ম্যাডামকে গত জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার করে জেলার গোয়েন্দা পুলিশ। মানব পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অর্ধডজন মামলা রয়েছে। ম্যাডাম হিসেবে পরিচিত শীর্ষ মানব পাচারকারী রেজিয়া আকতার রেবি উখিয়া-টেকনাফের উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে মানব পাচার করে আসছে। মানব পাচার মামলায় এর আগে তার স্বামী নুরুল কবিরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়ার পর রেজিয়া আকতার রেবির দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সন্ধান পাওয়া গেছে দেড় কোটি টাকার। সূত্র জানায়, ম্যাডাম রেবির সঙ্গে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মানব পাচারে জড়িত দালাল চক্রের প্রভাবশালী সদস্যদের যোগাযোগ রয়েছে। বহুল আলোচিত এই রেবি ম্যাডাম সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানব পাচারকারীদের একটি তালিকা সম্প্রতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। ওই তালিকায় অনেক গডফাদারের নাম রয়েছে বলে একটি সূূত্র নিশ্চিত করেছে।
ওই তালিকায় টেকনাফ, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের শতাধিক দালালের নাম রয়েছে। রয়েছে কক্সবাজার শহর, মহেশখালী ও চকরিয়াকেন্দ্রিক দালালের নাম। এর বাইরে বরগুনা, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের দালালের নামও রয়েছে তাতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, থাইল্যান্ডে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়কারী প্রভাবশালী সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে কক্সবাজারেও। তারা বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এসএ পরিবহনের কুরিয়ার সার্ভিস এবং বিকাশের মাধ্যমে এ টাকা আদায় করছে। বিভিন্ন সময়ে এই সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অভিযোগ করা হলেও তারা টাকা দিয়ে পার পেয়ে যায়।
কক্সবাজার উপকূলে মানব পাচারে শতাধিক নৌঘাট :অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার উপকূলে শতাধিক পয়েন্টকে ব্যবহার করে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার অব্যাহত রেখেছে দালালরা। ইতিমধ্যে এসব পয়েন্ট পুলিশ চিহ্নিত করেছে। পুলিশের তালিকামতে, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, বড়ডেইল, জাহাজপুরা, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, লেংগুরবিল, লম্বরী, মুন্ডারডেইল, বাহারছড়া, কচুবনিয়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, শাহপরীরদ্বীপ, গোলাচর, দক্ষিণপাড়া, জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, সেন্টমার্টিন, উখিয়ার মনখালী, সোনারপাড়া, কক্সবাজার সদরের চৌফলদণ্ডী, নাজিরারটেক, কস্তুরাঘাট, মহেশখালীর ঘড়িভাঙা, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, পেকুয়ার মগনামাঘাট, চকরিয়ার বদরখালী, মাতামুহুরীসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করা হচ্ছে। এসব ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোটে করে লোকজনকে গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত বড় জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।
মানব পাচার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে উখিয়া উপজেলার রেজু মোহনা, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ নৌ পয়েন্ট। এ ছাড়া কক্সবাজার সদরের নাজিরারটেক, বাঁকখালীর মোহনা, মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া, ঘটিভাঙাসহ আরও কয়েকটি নৌঘাট থেকে মানব পাচারের কথা জানিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
সূত্র জানায়, পেকুয়া উপজেলার করিমদাদ মিয়ার জেটিঘাট, মগনামা জেটিঘাট, আরবশাহ জেটিঘাট, কুতুবদিয়া দ্বীপের আলী আকবর ডেইল জেটিঘাট, উত্তর ধুরং আকবর বলী জেটিঘাট ও দরবার জেটিঘাট, চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের মাছঘাট, সাহারবিল ইউনিয়নের চোয়ারফাঁড়ি ঘাট, বদরখালী ইউনিয়নের বদরখালী বাজারঘাট, মালুমঘাট দিয়ে প্রতিনিয়ত মানব পাচার হয়ে আসছে।
খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, থাইল্যান্ডে গণকবরের খবর শুনে নিখোঁজদের স্বজনরা আতঙ্কিত। এসব পরিবারে এখন কান্নার রোল পড়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ জানান, আটক দালালদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠানো হলেও তারা কৌশলে জামিনে বের হয়ে আসছে। তাদের কেউ কেউ আবার মানব পাচারে জড়িত হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, একটি স্বার্থানেষী মহল বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম বিনষ্ট করার জন্য পাচারের মতো জঘন্য কাজে জড়িত। পুলিশ তাদের তালিকা তৈরি করে অভিযান চালাচ্ছে।

 

এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।