এরপর শুক্রবার তার নিখোঁজের এক মাস পূর্ণ হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কেউ তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি।
তিনি কোথায় আছেন, কিংবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা? নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটকের বিষয়টি কৌশলগত কারণে স্বীকার করছে না? সরকারি মহলের কারসাজি? না নিজেই আত্মগোপন করে আছেন? এমনই নানা প্রশ্ন দানা বেঁধেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন মহলে।
এর আগে একইভাবে নিখোঁজ হন বিএনপির নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। তবে সালাহ উদ্দিনের মত বড় মাপের নেতা এই প্রথম নিখোঁজ হলেন।
শনিবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, বিএনপির নিখোঁজ যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ জীবিত আছেন। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামানের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাতের পর তিনি এই আশা ব্যক্ত করেন। তাকে অচিরেই ফিরে পাবেন বলেও জানান তিনি।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজের আজ ২ বছর ১১ মাস ২৩ দিন। আর বিনপির অপর নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজের ৪ বছর ৯ মাস ১৫ দিন চলছে। এখনো তাদের কোন খোঁজ দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কেউ।
গত জানুয়ারির ১ তারিখে ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্র বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তার বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। তার ২ দিন পর তাকে গুলশান থানার একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে হাসপতালে ভর্তি করে গোয়েন্দা পুলিশ।
এরপর গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় টানা অবরোধ ও হরতালের সময় আত্মগোপনে থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংগঠনের কর্মসূচিসহ বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন। তাকে গ্রেফতার করতে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার বাসাসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। কিন্তু তাকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারেনি। সালাহ উদ্দিনকে গ্রেফতার করতে তার ব্যক্তিগত সহকারী ওসমান গণিকে গত ৫ মার্চ মিরপুরের একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গুলশানে সালাহ উদ্দিনের বাসার সামনে থেকে শফিক ও খোকন নামে তার দুই গাড়ি চালককে আটক করা হয়। পরে গত ১০ মার্চ মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তার দুই গৃহপরিচারিকাকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সালাহ উদ্দিন আহমেদের পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে এ দাবি করা হয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
সালাহ উদ্দিন নিখোঁজের শুক্রবার ১ মাস পূর্ণ হলেও কোথাও তার খোঁজ মেলেনি।
এ ঘটনার পর র্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা সালাহ উদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা করে আসছিল। তবে তার সন্ধান না পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার বা আটক করেনি তারা। তিনি আত্মগোপনে আছেন কিনা বা কোথায় আছেন সেটাই খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঘটনার পর একাধিক মন্ত্রী ও সরকার দলের নেতারা বলেছেন, সালাহ উদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে রয়েছেন।
তবে সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদের অভিযোগ, সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার স্বামীকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে সালাহ উদ্দিন অবস্থান করছিলেন৷ ওই বাসার দারোয়ানকে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকে দোতলার দরজা ভেঙে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়।
এ ঘটনার পর উত্তরা গুলশান থানায় জিডি করতে গেলে তাদেরকে উত্তরা পশ্চিম থানায় পাঠানো হয়। পরে সেখানেও জিডি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। একপর্যায়ে উচ্চ আদালতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতার কারণে পুলিশ বাদী হয়ে জিডি করেন। এর আগে পুলিশের আইজি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আটক বা গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা বলেন, তাকে উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।
এরপর সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করার জন্য তার স্ত্রী সাবেক এমপি হাসিনা আহমেদ হাইকোর্টে এক রিট আবেদন করেন। পরে আদালতে তাকে হাজির করার প্রশ্নে হাইকোর্ট কারণে দর্শানোর নোটিশ জারি করেন। হাইকোর্ট স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি এবং র্যাবের ডিজিসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন।
গত বৃহস্পতিবার ওই রিট আবেদনের শুনানি হয়। আগামী ১৫ এপ্রিল বুধবার রিট আবেদনের ব্যাপারে আদালত রায় দেবেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ তার স্বামীকে খুঁজে বের করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একাধিকবার আবেদন করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টাও করে আসছেন।
এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের মুক্তি দাবি করেন। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, আমাদের যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দিন।
অন্যথায় পরিণতি শুভ হবে না। গুলশানের বেগম জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি দলের অপর যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদেরও মুক্তি দাবি করেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ নিয়ে ‘বক্তব্য’ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কাছে দেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত তথ্য থাকার কথা সকল মহল বিশ্বাস করেন। তিনি কিসের ভিত্তিতে সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তা নিয়েও নানা মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
অপর দিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ২০ দলীয় জোটের পক্ষে মুখপাত্র বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সালাহ উদ্দিনকে বেগম খালেদা জিয়া ময়লার বস্তায় ভরে পাচার করে দিয়ে থাকতে পারেন বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অবাস্তব, আজগুবি ও নিষ্ঠুর পরিহাস করেছেন। তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। দেশবাসী তার কাছ থেকে দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে। দায়িত্বহীন ও বিকৃত মানসিকতার মস্করা নয়। এমন একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে এ ধরনের বিদ্রুপাত্মক উক্তি করে সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। অবৈধ পন্থায় ক্ষমতাসীন হলেও শাসন-কর্তৃত্ব তাদের করায়ত্ত্বে। কাজেই প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব।’
অপরদিকে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আন্তরিক প্রচেষ্টা দিয়ে খোঁজার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী আয়োজিত ‘চলমান রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা সভা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন আহমেদ উত্তরে না দক্ষিণে, পূর্বে না পশ্চিমে যেখানেই থাকুক তাকে খুঁজে বের করা হোক। যার ‘মাল’ তাকে বুঝিয়ে দেয়া হোক।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, কিছুদিন ধরে শুনতে পাচ্ছি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ, তিনি তো অনেকদিন থেকেই আত্মগোপনে। খালেদা জিয়া সরকারের কাছে সন্ধান দাবি করছে, সালাহ উদ্দিনসহ যে সকল নেতাকর্মী আত্মগোপনে, তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের নয়, খালেদা জিয়ার বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ আয়োজিত ‘অযৌক্তিক হরতাল-অবরোধের প্রতিবাদ’ সমাবেশে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এদিকে গত ১৯ মার্চ রাতে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার দুর্গম চরাঞ্চলে সালাহ উদ্দিন আহমেদের লাশ পাওয়ার গুজব উঠেছিল। পরে সেখানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তল্লাশি চালিয়ে কোনো লাশের সন্ধান পাননি। পরে এই গুজব ছড়ানোর দায়ে চট্টগ্রাম থেকে দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়।
এর আগে গত ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী রাতের আঁধারে ঢাকার বনানী থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর সন্ধান আজও মেলেনি।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কেউই এ ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারেনি। এমনকি ইলিয়াস আলী আদৌ বেঁচে আছেন কিনা- এ হদিসও কেউ দিতে পারছেন না। স্ত্রী-সন্তান আজও তার প্রতীক্ষায়। প্রায় তিন বছরেও সন্ধান মেলেনি এই বিএনপি নেতার। ফলে ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঘটনাটি রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। নিখোঁজ ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তর্জন গর্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও ছেলে ফিরে আসবে এই আশায় পথ চেয়ে আছেন মা সূর্যবান বিবি। তিনি সাংবাদিকদের দেখলেই তার একটাই আর্তি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলে ভিক্ষা চাই। আমি আর কিছু চাই না। ইলিয়াস আলীকে একবার দেখে মরতে চাই। কিন্তু তিনি আদৌ জানেন না তার ছেলে ফিরবে কি না।
এর আগে গত ২০১০ সালের ২৫ জুন বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। তার নিখোঁজের প্রায় ৪ বছর ৯ মাস ১৫ দিন মাস পার হলেও এখনো কোন সন্ধান করতে পারেনি কেউ। তবে তার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাদের ধারণা চৌধুরী আলম এখনো বেঁচে আছেন।
তবে কি সালাহ উদ্দিনও ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের পথে? তার স্বজনদেরও কি গুণতে হবে এমন অনিশ্চিত প্রহর?
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।