এ এইচ সেলিম উল্লাহ: মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে স্থলপথে কড়াকড়ি আরোপ করেছে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থা। এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আয়ের পথ খুলছে অর্থলোভী দালাল চক্র। দেশের ভেতর পছন্দ জায়গায় রোহিঙ্গাদের পৌছে দিতে এবার নৌ-পথকে ব্যবহার করছে চক্রটি। মরিয়া হয়ে উঠা এ সব দালাল চক্রের মধ্যে উখিয়া-টেকনাফের মালয়েশিয়া মানবপাচারকারি চক্ররাই সক্রিয় বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের লোভ ও নিজেদের অজানা সুখের আকাঙ্খা মৃত্যুরর দোয়ারে ঠেলে দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের। এমনটি মনে করছেন উপকূল এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল।
উখিয়ার উপকূলবর্তী জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী ও পর্যটন ব্যবসায়ী ইনানী বীচ এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের মতে, এভাবে উপকূল দিয়ে রোহিঙ্গাবর্তী একটি ট্রলার বৃহস্পতিবার বৈরি আবহাওয়ায় পড়ে ডুবে গেছে। এতে এপর্যন্ত ২০ নারী-শিশুর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে আরো অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। তাই স্থল পথের মতো নৌ-পথেও নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
অপরদিকে প্রশাসনের তথ্য মতে, রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় গত এক মাসে পৃথক ভাবে এ পর্যন্ত ১২৯ জন রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
ইনানীতে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে উদ্ধার হয়ে উখিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিয়ানমারের বুচিডং থানার মুইদং এলাকার আবুল কালাম (৪৫) শুক্রবার সকালে জানান, আমীর সাহেব নামের একজন লোক মালয়েশিয়া থেকে ফোন করে আমাদেরকে বোটে উঠে বাংলাদেশে চলে আসার কথা বলেন। তিনি টাকা-পয়সা সব বোট মালিককে দিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। তার তথ্য মতে, তারা বুধবার রাত ৮টার দিকে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা ওই বোটে উঠে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বোটে তার স্ত্রী,ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের ৭জন ছিল। তিনি এবং ২মেয়ে জীবিত উদ্ধার হলেও স্ত্রী ফিরোজা খাতুন(৪০) মেয়ে শাহেদা (১৪) মারা যায়। তাদের লাশ পাওয়া গেলেও আরেক মেয়ে ছেনুয়ারা বেগম(৯) এখনো নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
পরে তিনি আরো বলেন, তার শ্যালক মো. কাছিম জীবিত উদ্ধার হলেও, তার স্ত্রী শাহজান খাতুন (৩৫) এবং তাদের আড়াই বছরে শিশু রুখিয়া ও আরেকটি ১ বছরের ছোট শিশু মারা যায়।
মিয়ানমারের বুচিদংয়ের মুইদং এলাকার জামাল হোসেনের স্ত্রী রাশেদা বেগম(২৩)ও চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালে। তিনি জানান, তিনি কোন রকম কূলে আসতে সক্ষম হলেও তার ৭মাসের মোহাম্মদ হোসাইন নামের এক ছেলে সন্তান ছিটকে পড়ে সাগরে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার এই সন্তান বেঁচে আছে কিনা জানেনা। তখন এ প্রতিবেদক কয়েকটি শিশুর লাশের ছবি দেখালে তৎমধ্যে সে তার মোহাম্মদ হোসেনকে সনাক্ত করেন। এসময় তার আহাজারী পুরো হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। তাদের পাশের বেটে শুয়ে আছে জীবিত উদ্ধার আরেক রোহিঙ্গা যুবতি মিয়ানমারের বুচিদং থানার একই এলাকার আমিনা খাতুন (১৮)। তিনি বলেন, তার পিতা লালু মিয়া এবং ভাই জাফর আলম বেঁচে আছেন। কিন্তু তার ভাবি জাফর আলমের স্ত্রী তৈয়বা খাতুন, তাদের যমজ ২সন্তান নুর কামাল ও জুবাইদা খাতুন মারা গেছে।
আমিনা আরো জানায়, তারা জনপ্রতি মিয়ানমারের ২০হাজার কিয়াত (টাকা) ভাড়ায় এদেশে পাড়ি দিয়েছিল। টেকনাফ এলাকায় না নামিয়ে তাদের অন্য একটি কোন জায়গায় যেন নামানোর কথাছিল। যেখান থেকে বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় যাওয়া যাবে বলে ট্রলার মাঝিরা বলেছিলেন। কিন্তু মাঝপথে বোটটি ঝড়ের কবলে পড়ে সব উলট-পালট করে দিয়েছে। ওপারে মরলে মনকে বোঝাতে পারতাম মিয়ানমার সেনা ও মগরা মেরে ফেলেছে। কিন্তু এখন বেঁচে যাওয়া কেউই মনকে বোঝাতে পারছি না।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী মোস্তাক মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে সাগরে মাছ শিকার করতে গেলে একটি ট্টলার উপকুলে দিকে ভেসে আসতে দেখা যায়। পরে সেখানে গিয়ে কোন লোকজন দেখতে না পেয়ে একটু ভয় সৃষ্টি হয়। কিন্তু সাগরে অদুরে কয়েক লোক জীবিত ভাসতে দেখে তিনি পাটুয়ারটেক এলাকার আরো কয়েক লোককে খরব দেয়। ততক্ষণে সাগরে ঢেউয়ের সাথে উপকূলে ভেসে আসতে শুরু করে জীবিত ও মৃত লাশের সারি।
উদ্ধারকর্মী স্থানীয় রেড ক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবক ও পল্লী চিকিৎসক আব্দুল আজিজ বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সাগর থেকে ২০জনের মৃত দেহ উদ্ধার করেছি। এসময় প্রশাসনের সহযোগিতায় মুমুর্ষ অবস্থায় ১৮জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করি। এরা হলেন-আনোয়ার সাদেক তার ভাই মোহাম্মদ সাদেক, তসলিমা বেগম, শাহেদ, আব্দুস সলাম তার ভাই আব্দুল গফুর, আব্দুর রশিদ, আবুল কালাম সহ ১৮জন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, উদ্ধার হওয়া লাশ গুলো স্থানীয় গ্রামবাসির সহযোগিতায় উপকূলের ইনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর জীবিত উদ্ধারকৃতদের উখিয়া ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচারের মতো রোহিঙ্গা পরিবহণ শুরু হলো কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি ভেবে দেখার মতো একটি ঘটনা। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে বিসয়টি জানানো হয়েছে এখন জলপথেও নজদারি বাড়াতে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র আফরোজুল হক টুটুল বলেন, আমরাও এটা মাথায় নিয়ে সবদিক সতর্ক নজর রাখছি। সকাল থেকে উখিয়া-টেকনাফের উপকুল এলাকায় অভিযান চালিয়েছি। স্থানীয়রা কেউ লোভী বোট মালিকদের ব্যাপারে তথ্য দিচ্ছে না। আমরা চাচ্ছি যারাই এ অপকর্মের সাথে জড়িত থাকুক, খোঁজ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে তিনি সংবাদকর্মী ও জনপ্রতিনিধিসহ সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।