সীমান্ত জনপদ টেকনাফের প্রত্যন্ত এলাকা যেহারে যাবতীয় মাদক ও মানব পাচারের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে তা বিশ্ব দরবারে পুরো দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের গৌরবময় অবস্থান অটুট রাখতে হলে এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে অব্যাহত অভিযানের পাশাপাশি সীমান্ত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন,রোহিঙ্গা নাগরিকদের নির্দিষ্টস্থানে স্থানান্তর এবং টেকনাফের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে সচেতন মহল মনে করেন।
জানাযায়,ভূগৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এককালের টেকনাফ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। জনসংখ্যা ছিল তুলনামুলক কম। বৃটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার একই বলয়ে থাকায় অবাধ যাতায়াত এবং আতœীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় এই জনপদে বর্তমান বাংলাদেশ-মিয়ানমার কেন্দ্রিক বাণিজ্য প্রথা চালু হয়। তাই এপার-ওপার আসা-যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে পৃথক দেশ স্বাধীন হলেও এই অবস্থার ব্যতিক্রম হয়নি। এখানকার মানুষের জীবন-যাপন,সরলতা এক সময় সারাদেশের মানুষের মধ্যে প্রশংসার দাবীদার ছিল। সাগর-নদীতে মাছ আর পাহাড়ে গাছ-পালায় ভরপুর ছিল। স্বল্প সংখ্যক মানুষ হওয়ায় খুব আরাম আয়েশে দিন কাটিয়ে যেত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর হতে নিজস্ব সীমারেখা তৈরী হওয়ায় উভয় পাড়ে অবাধে যাতায়াতে নেমে আসে কড়াকড়ি। কিন্তু আশির দশকে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর হতে আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে এখানকার মানুষের আচার-আচরণ। ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠে স্বার্থপর ও হিংস্র। এই স্বার্থপরতা ও হিংস্রতা এতই উগ্র হয়ে উঠেছে যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য কথায় কথায় দা,কিরিচ,ছোরা, লোহার রড এবং অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে নিমিষেই স্তদ্ধ করে দিচ্ছে জীবন প্রদীপ। আবারো দ্বিতীয় দফায় ১৯৯৭ সাল হতে এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। টেকনাফের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা হওয়ায় শ্রমবাজার দখল, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, পতিতাবৃত্তি, ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের ব্যবহার করায় পুরো টেকনাফের পরিবেশে একযুগের মধ্যে ভিন্নরূপ ধারণ করে। বেড়ে যায় জবর দখল, অপহরণ, খুন, গুম, আধিপত্য বিস্তার এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার। বর্তমানে টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিষ্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্প, লেদা আনরেজিষ্টার্ড ক্যাম্প, প্রত্যন্ত এলাকার ভাড়া বাসা, বাহারছড়া সাগর উপকূলে রোহিঙ্গা বস্তিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা বাঁচার তাগিদে মাদক বাণিজ্য, মানব পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তখন এসব নিয়ে এত হৈ ছৈ ছিল না। এখন তাদের দেখানো পথে এদেশীয় জনসংখ্যার একটি অংশ পা দিয়ে সুবিধাভোগী হওয়ায় সবাই বড় লোক হওয়ার আশায় ছুটতে ছুটতে এখন নিজেদের অস্থিত্ব হারানোর পথেই। একুশ শতকে পা দেওয়ার পর পরই এখানকার মানুষ হঠাৎ বড় লোক হওয়ার সর্বনাশা ইয়াবা, ড্রাইজিন, হুইস্কি, ম্যান্ডেলা রাম ও বিয়ার জাতীয় মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। কাঁচা পয়সা রোজগার করে বড় লোক হওয়ার আশায় বেশিরভাগ লোকজন এই পথে পা বাড়ায়। অনেক ভবঘুরে বেকার, আদম ঘাটের দালাল, গাড়ি-চালক, চাকরীজীবি, এমন কি মাওলানা পর্যন্ত এই ব্যবসা করে হঠাৎ কোটিপতি, সমাজের সর্দার এবং এলাকার মাতবর বনে গেছে। এই কালো টাকার দাপটে এলাকার জ্ঞানী-গুণীদের কদর কমতে শুরু করে। মানুষ সন্তানদের শিক্ষিত করার পরিবর্তে টাকা ওয়ালা করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই এখন টেকনাফে মাদক বাণিজ্যের চেয়ে সেবনকারী সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ঢাকায় মাদক সেবনের টাকার জন্য পুলিশ কন্যা ঐষী রহমান যে ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। টেকনাফে ঠিক মাদক সেবন ও মানব পাচারের টাকার জন্য জবাই করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা আগামীতে এই জাতির ভাগ্য ললাটের অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। সুতরাং এসব অপরাধ কঠোর হাতে দমন সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে। এখন টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গাসহ প্রায় ৪লক্ষ জনসাধারণের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ এসব অপরাধ থেকে বিরত রয়েছে। তাই মাদক ও মানব পাচার এবং অস্ত্রবাজিরোধ স্বল্প সংখ্যক মানুষের প্রতিবাদ নয় বরং এখন দেশের ভবিষ্যত রক্ষার চ্যালেঞ্জ ও বিশেষ অভিযান।
কিন্তু এই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানি এবং বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কি না তাও মাথায় রাখা দরকার। অবশ্যই বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং উদ্ধ্যুদ্বকরণ সভায় এই বিষয়ে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হলেও সুক্ষ কৌশলে এই কাজ চলছে বলে গুজব উঠেছে।
এদিকে ২০১০সাল হতে টেকনাফ উপকূল ও সাগর পথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একদিকে দালালেরা স্বল্প মুল্যে কর্মসংস্থানের সুযোগের স্বপ্ন দেখানো অপরদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাহিরে শ্রমশক্তি প্রেরণের ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে এখানকার জনপ্রতিনিধি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দূর্বলতার সুযোগকে ব্যবহার করে পুরো টেকনাফ দখল করে নেয় ইয়াবাসহ যাবতীয় মাদক পাচারকারী ও মানব পাচারকারী সিন্ডিকেট। সেই সাথে নষ্ট করছে জাতির প্রাণশক্তি যুব সমাজ এবং কত ছেলে হারিয়েছে মা-বাবা,স্বামী হারিয়েছে স্ত্রী,বাবা হারিয়েছে ছেলে-মেয়ে,ভাই হারিয়েছে বোন,দোলা ভাই হারিয়েছে শালা-শালী,মামা হারিয়েছে ভাগিনা-ভাগিনী,নানা হারিয়েছে নাত-নাতনী তার কোন হিসেব নেই। তবুও টাকা লোভী মাদক,মানবপাচারকারী দালাল এবং অস্ত্রবাজদের অপতৎপরতা মুখের ভাষায় বন্ধ না হওয়ায় প্রশাসন বাধ্য হয়ে অস্ত্রের ভাষায় এসব দমনে কথা বলতে শুরু করেছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। কিন্তু তা করার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে নিমোক্ত ৩টি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হলে নৈতিক অবক্ষয়ের যাতাকলে পড়া টেকনাফকে রক্ষা করা সম্ভবপর হবে বলে সচেতনমহল মনে করেন।
রোহিঙ্গা স্থানান্তর:টেকনাফের ৬টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌর এলাকার বিভিন্ন ভাড়াবাসা, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ক্যাম্প, সরকারী পাহাড়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস। তাদের দেশের কোথাও নির্দিষ্ট এলাকায় স্থানান্তর করা হলে দেশীয় মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে।
সীমান্ত ব্যবস্থা: নদী ও সাগরে কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর কর্মতৎপরতা সক্রিয় করার পাশাপাশি সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে নাফনদী ও বঙ্গোপসাগর উপকূলে তৎপরতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব বিওপি চেকপোস্ট সমুহ রয়েছে তাদের উভয় পাশের টহল ব্যবস্থার তত্তাবধানে মাছ শিকারী জেলে,সাধারণ মানুষের চলাফেরা নির্দিষ্ট পয়েন্ট ভিত্তিক হলে মাদকের চালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশরোধ কিছুটা হলেও কমবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি:চোরাচালান নিরুসাহিত করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে জনবল বাড়িয়ে সরকারী আয়বর্ধক এবং স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যেমন পর্যাপ্ত সীমান্ত করিডোর,বর্ডার ট্রানজিট পাস চালু হলে মানুষ অবৈধ পথ ছেড়ে বৈধ পথে এসে জীবিকা নির্বাহ করবে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ঘটবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে টেকনাফে দায়িত্বরত প্রশাসন সমন্বয় করে জরুরী ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগে আলোচনা স্বাপেক্ষে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে টেকনাফের সেই হারানো ঐতিহ্য ফিরে আনা সম্ভব বলে মনেকরে এখনো আশায় বুক বাঁধতে চায় হতাশ জনসাধারণ এবং অভিভাবকগণ
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।