কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে/চলে যেতে হবে আমাদের।/চলে যাব, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’-সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার শেষ কয়েকটি পঙ্ক্তি ঠিক এভাবে উদ্ধৃত হলেও মিয়ানমার জান্তার কাছে এ যেন ‘উপহাস’। রাখাইন রাজ্যে জন্ম নেয়া বেড়ে ওঠা শিশুদের স্থান ছেড়ে দেয়া তো দূরের কথা তাদের স্থানচ্যুত করা হয়েছে। বাসযোগ্য পৃথিবীর পরিবর্তে শিশুদের উপহার দেয়া হয়েছে ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসস্তূপ ও মৃত্যু উপত্যকা থেকে পালিয়ে পিতা-মাতার সঙ্গে কিংবা অভিভাবকহীন হয়ে বাংলাদেশে আসা লাখো রোহিঙ্গা শিশু এখন জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকিতে। বাংলাদেশ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইতিহাস গড়েছে। তাদের থাকার জায়গা দিয়েছে। যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে শারীরিক, মানসিক উভয় চিকিৎসা দেয়ার। যে সরকার তার দেশের শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবীর পরিবর্তে ধ্বংসস্তূপ উপহার দেয়। সেই সরকারের কাছে এসব শিশু ও তাদের অভিভাবকদের কোনো প্রত্যাশা নেই। যে সরকার পরম মমতায় তাদের আশ্রয় দিয়েছে, সেই সরকারের কাছেই তাদের প্রত্যাশা, শিশুদের জন্য যেন একটা বাসযোগ্য পৃথিবীর। যাতে আশ্রয় শিবিরের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকার ঠেলে শিশুরা আলোর পথে বেরিয়ে আসতে পারে।
সূত্র মতে, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা আড়াই লাখ। দুই লাখ ৫০ হাজার শিশুর ৬০ ভাগই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এরা এখন নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। এদের কেউ বাবা-মা’র সঙ্গে এসেছে। কারও মা-বাবাকে চোখের সামনেই হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনা বা মগরা। এরা বাবা-মা হারিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশ ছেড়েছে। অভিভাবক ছাড়াই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা শিশুই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সর্দি-কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমুনিয়া, আমাশয়ে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকছে। যেসব শিশুর মা আছে তারাও চরম কষ্টে পড়েছেন। অভুক্ত শিশুদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে দৌড়াচ্ছেন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। পাশাপাশি অসুস্থ শিশুদের নিয়ে লাইন দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা ক্যাম্পে। মিসিং সেন্টারে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে পিতা-মাতা হারানো শিশু। স্বজন ফিরে পাওয়ার কান্না চলছে সেখানে। উখিয়া-টেকনাফের রাস্তায় রাস্তায় কিংবা ক্যাম্পে ক্যাম্পে নিষ্পাপ ও কোমল-কচি শিশুমুখের ছড়াছড়ি। জাতি চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসের (সিএসফ) তথ্য অনুযায়ী কেবল অভিভাবকহীন (যাদের পিতা-মাতাকে হত্যা করা হয়েছে) শিশুই রয়েছে অন্তত ১ হাজার ৪শ’। ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় যে মিসিং সেন্টার খোলা হয়েছে সেই সেন্টারেও প্রতিনিয়ত স্বজনহারা শিশুদের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। বন-জঙ্গলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাত নামলেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। শিশুদের মধ্যে সঞ্চার হয় ভয়ের। হাতির গর্জন, সাপ-বিচ্ছুর ভয় কিংবা মশার কামড় যেন রোহিঙ্গা শিশুদের নিত্যসঙ্গী।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম রোববার বলেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মোট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশই শিশু। এদের অনেকেই নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। ডায়রিয়া, নিউমুনিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশি, আমাশয়, চর্মরোগ ও অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে তারা। সিভিল সার্জন জানান, নির্ধারিত কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সরকারিভাবে খোলা হয়েছে আরও ১৩টি ক্যাম্প। চিকিৎসার জন্য বাড়তি যুক্ত করা হয়েছে ৪০ জন চিকিৎসক। ৪২ জন নার্স ও সাপোর্টিং জনবল। এছাড়া বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত ওষুধ দেয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। ওষুধের কোনো সংকট নেই বলে জানান তিনি। সিভিল সার্জন আরও বলেন, সরকারি ক্যাম্পগুলোর পাশাপাশি বেসরকারিভাবে আরও অন্তত ২৫টি চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে রোহিঙ্গা ও তাদের শিশুদের চিকিৎসাসেবায়।
উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং, পালংখালী পানবাজারসহ বিভিন্ন চিকিৎসা ক্যাম্পে কয়েকদিন ঘুরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা মায়েরা সন্তান কোলে নিয়ে ভিড় করছেন চিকিৎসার জন্য। প্রেসক্রিপশন কিংবা ওষুধ পেলেও অনেক মাই বুঝতে পারছেন না ব্যবস্থাপত্র। কীভাবে ওষুধ খাওয়াবেন সেই নিয়ম বুঝছেন না। তাই তারা যাকেই দেখতে পাচ্ছেন ক্যাম্পে তাদের কাছ থেকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছেন ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম-কানুন। পালিয়ে আসা প্রায় সব নারীর কোলেই রয়েছে এক থেকে সর্বোচ্চ ৫-৭টি বাচ্চা।
উখিয়ায় ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় পরিচালনা করা হচ্ছে চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস (সিএফএস) নামে একটি সংস্থা। ওই সংস্থার হিসাব মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত এক হাজার ৪০০ জন শিশু আছে যারা চোখের সামনে পিতা-মাতাকে হত্যা করতে দেখেছে বা পিতা-মাতা হারিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে অন্যদের সঙ্গে। এমন অন্তত ৬০ জন শিশু রয়েছে এই সেন্টারে। দীর্ঘ পথ, বন-জঙ্গল ও নদী পাড়ি দিয়ে এখন বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন শুরু করেছে। এদের মধ্যে রশিদ, দিলারা, আজিজা, নূর হোসেন, জোহরা, আঞ্জুমান, বাহাদুর, সুমন রয়েছে। যাদের পিতা-মাতা হারানোর দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তারা মানসিকভাবে যে আঘাত পেয়েছে এই সেন্টার সেই আঘাত থেকে পরিত্রাণ দেয়ার চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পালিয়ে এসে বাংলাদেশে শরণার্থী জীবন শুরু করা এসব শিশু এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকেই যাত্রা শুরু করেছে। কেউ জানে না তাদের এই যাত্রা কোথায় গিয়ে শেষ হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী পালিয়ে আসা দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এরই মধ্যে টিকা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৫৬ হাজার এমআর টিকা, ২০ হাজার জনকে বিওপিভি টিকা, ১৫ হাজার জনকে ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো হয়েছে। পরিবার-পরিকল্পনা মিডওয়াইফারদের হাতে জন্ম নিয়েছে ১৭৩ শিশু। গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী রয়েছেন ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার। অর্থাৎ সমানসংখ্যক শিশু পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায়। যাদের সামনেও অপেক্ষা করছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
এদিকে কুতুপালং শরণার্থী শিবির এলাকায় একটি মিসিং সেন্টার খোলা হয়েছে। রোহিঙ্গারা দলে দলে আসতে শুরু করার কয়েকদিন পরই বিদেশি সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় এই সেন্টার খোলা হয়। সেন্টারের সামনে কয়েকদিন গিয়ে দেখা গেছে এক করুণ পরিবেশ। সন্তান হারানো পিতা-মাতাদের ভিড় যেমন আছে এখানে তেমনি পিতা-মাতা হারানো শিশুদের খুঁজে পাওয়ার পর এখানে জমা রাখা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে শিশুর খোঁজ পাওয়ার কথা। গত সোমবার এই সেন্টারের ভেতরে বসে কাঁদতে দেখা যায় রুম্মান আক্তার (১২) ও আবদুর রহিম (৭) নামে দুই ভাইবোনকে। পালিয়ে আসার পথে তারা মা-বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে। অভুক্ত থাকতে থাকতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আরেক শিশুকে দেখা গেল মাটিতে গা এলিয়ে ছিন্নকাপড়ে নীরব হয়ে আছে। এই সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নাজির আহমদ জানালেন, শিশুটির গায়ে জ্বর। তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে। নজির আহমদ তথ্য দিলেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। সেন্টার খোলার পর থেকে ৩০০ শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ হারিয়ে যাওয়ার তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৬৫ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তাদের স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। মিসিং হওয়াদের মধ্যে ৫ বছর থেকে ১০ বছর বয়সী ১০৮ জন ছেলে সন্তান ও ১২১ জন কন্যা সন্তান রয়েছে। অন্যদের বয়স ১৮ বছরের ওপরে। পথঘাট না চিনে কে কোথায় হারিয়ে গেছে তার খোঁজ পাচ্ছে না স্বজনরা। মিসিং সেন্টারে বসে কাঁদতে থাকা শিশু রুম্মান জানায়, তারা দুই ভাইবোন (রুম্মান ও রহিম) তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা মিয়ানমারের তমবাজার থেকে পালিয়ে এসেছে মায়ের সঙ্গে। বাংলাদেশে এসে মাকে হারিয়ে ফেলেছে।
রেড ক্রিসেন্ট পরিচালিত একটি চিকিৎসা ক্যাম্পের পরিচালক ডা. সোহেল। তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি। যে হারে রোগী আসছে সে হারে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে বা ওষুধের সংকট আছে বলে জানালেন তিনি।
উখিয়ায় চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনাকারী ড্যাব নেতা ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী বলেন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা করা না গেলে, পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা না গেলে এবং সময়মতো চিকিৎসা করা না গেলে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে বাসস জানিয়েছে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্র্যাক আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ৬০টি মেডিকেল টিম গঠন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেবা দেবে। এ সময়ের মধ্যে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে নতুনভাবে আশ্রয় নেয়া ৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মানসিক চাপ কমাতে ইতিমধ্যে ৫ হাজারের বেশি শিশুকে খেলাধুলা ও গল্প বলার মাধ্যমে বিনোদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্র্যাক। এ পর্যন্ত কুতুপালং, লেদা ও শ্যামলাপুরে স্থায়ী তিনটিসহ ছয়টি শিশুবান্ধব কেন্দ্র এবং কিশোরী ক্লাব স্থাপন করেছে।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।