শামসুল হক শারেক:
১৯৭০ এর নির্বাচনী ডামাডোলে আমি ছিলাম ২য় শ্রেণীর ছাত্র। ওই বয়সে বুদ্ধিশুদ্ধি যা হয় তানিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতাম বিভিন্ন নির্বাচনী সভাগুলোতে। তখন কক্সবাজারের আদালতে একটি মামলার সুবাদে বাবার বিশ্বস্ত আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী ও জেলার প্রথম শ্রেণীর জমিদার (মরহুম) এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরী। তখন ন্যাশনাল এসেম্বেলিতে কিতাব মার্কা নিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রার্থী ছিলেন এড.ফিরোজ আহমদ চৌধুরী। বাবার বিশ্বস্ত আইনজীবী হিসেবে আমরা বুঝে না বুঝে তাঁর সমর্থক ছিলাম। এখনো মনে আছে বাবার সাথে উখিয়া ডাকবাংলো মাঠে কিতাব মার্কার সমর্থনে এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর একটি নির্বাচনী জনসভায় যোগদানের
কথা। এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ফিরোজ মিয়া হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ছোট বেলা থেকে আমিও তাঁকে ফিরোজ মিয়া হিসেবেই চিনতাম।
বাবার আরেক বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন উখিয়ার ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের রত্মাপালং ইউপির দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান (মরহুম) শমশের আলম মিয়া। তাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমাবেশ গুলোতে যেতাম শিশু বন্ধুদের নিয়ে। তখন পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রচারণা এবং নির্বাচনী সমাবেশ গুলো হত খুবই জমজমাট। আমরা হৈহুল্লা করে বেশ মজা পেতাম সভা সমাবেশ গুলোতে।
কে জানত পরবর্তীতে ১৯৮১ সাল থেকে ছাত্র জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আজ পর্যন্ত আমার কর্মজীবনের প্রায় ৩০টি বছর এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর হোটেল প্যানোয়াকে কেন্দ্র করে অতিবাহিত হবে। সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্ম জীবন বলতে গেলে হোটেল প্যানোয়াকে কেন্দ্র করেই চলছে।
১৯৮১ সাল থেকে প্যানোয়া কেন্দ্রিক আমার যাতায়াত। ২০০০ সালে আমি দৈনিক ইনকিলাবে যোগদান করি। ২০০৪ সালে হোটেল প্যানোয়ায় দৈনিক ইনকিলাবের আঞ্চলিক অফিস স্থাপনের পর এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরী পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তাঁর ৬ সন্তান যথাক্রমে- মরহুম ওসমান চৌধুরী বাবলু মিয়া, এজাজুল ওমর চৌধুরী (বাট্টু মিয়া), এড. আবুবুকর ছিদ্দিক, ডা. মোস্তফা আলী রেজা, মোহাম্মদ আল জুবায়ের (মানিক মিয়া) ও আলহাজ্ব আলী হাচ্ছান চৌধুরী (ছোট মিয়া) সকলের সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। এডভোকেট সাহেব ছাড়া অন্য সবাই এখন আমেরিকা প্রবাসী।
পরিচয় হওয়ার পর থেকে এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরীকে আমি চাচা করে ডাকতাম। তবে তাঁর পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের কাছে আমি থাকতাম সব সময় ভয়ার্ত। আমার এক শিক্ষক চট্টগ্রাম দারুল মায়ারিফ আল ইসলামিয়ার সহকারী পরিচালক আল্লামা ফোরকানুল্লাহর কাছে শুনেছিলাম এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও দেশের প্রখ্যাত আলেম ওলামাদের সোহবতে তিনি ছিলেন ইসলামী জ্ঞানেরও একজন পন্ডিত। তাই তাঁকে আমি খুবই ভক্তি এবং শ্রদ্ধা করতাম। অনেক সময় দেখেছি ওলামায়ে কেরামরা ঘন্টার পর ঘন্টা চাচা ফিরোজ মিয়ার পাশে বসে জ্ঞান চর্চা করতে। অনেকবার দেখেছি বাড়ির আঙিনায় ফিরোজ মিয়ার উপস্থিতিতে বড় বড় ইসলামী সমাবেশ ও লোকজ সংস্কৃতি জারি গানের জমজমাট আসর।
এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ১৯২২ ইংরেজি সালের ২রা ফেব্রুয়ারী কক্সবাজার জেলার প্রখ্যাত জমিদার পরিবার পেকুয়ার গুরামিয়া চৌধুরীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। ৮১ বছর বয়সে ২০০২ সালের ২২ ডিসেম্বর কক্সবাজার শহরের লালদিঘীর পাড়াস্থ হোটেল প্যানোয়া সংলগ্ন নিজের বাস ভবন ‘দারুল আমান’-এ তিনি ইন্তেকাল করেন।
এড. ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর ঈর্ষণীয় বর্ণাঢ্য জীবন নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। পেকুয়ার জিএমসি ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা, চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, কলকাতা সেন্ট জেভিয়াস কলেজ থেকে বিএ,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেক এম,এ, এবং ১৯৫২ সালে মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থানসহ, ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয় থেকে এল,এল,বি পাশ করেন তিনি।
ছাত্র জীবন শেষ করে মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ১৯৫৪ সালে (২১ শে মার্চ) শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক’র কৃষক প্রজা পার্টি হতে যুক্ত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার আইন কলেজ ও কক্সবাজার সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন কক্সবাজার সদরে অবস্থিত ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ইসলামিক সেন্টারের অধীন উমিদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা, এতিমখানা, হেফজখানা, ইসলামী পাঠাগার ও জামে মসজিদ। উক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি কক্সবাজার পৌরসভা সংলগ্ন ৩ একর জায়গাও ওয়াক্ফ করেন। এছাড়াও তিনি নিজের এলাকায় অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।
তাঁর ইন্তেকালের পর মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র আলহাজ্ব আলী হাচ্ছান চৌধুরী ‘এড. ফিরোজ আহমদ ফাউন্ডেশন’ গঠন করে মরহুমের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আলী হাচ্ছান চৌধুরীর তত্বাবধানে মসজিদ, মাদরাসা, প্রাইমারী স্কুল ও এতিম খানাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং পরিচালিত হচ্ছে।
ইসলামী শিক্ষার প্রসারে কক্সবাজার জেলার এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে তাঁর অনুদান অনস্বীকার্য। তিনি এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে দানবীর হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ী পেকুয়ার জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি কৃষি ও লবণ চাষীদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংসদে ও বাইরে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তিনি সর্বপ্রথম কক্সবাজার এলাকার ভূমিহীন প্রান্তিক লবণ চাষীদের জন্য খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার এবং কর মওকুফের ব্যবস্থা করেন।
তিনি উপমহাদেশের বৃহত্তম সমবায় সমিতি বদরখালী কৃষি সমবায় সমিতি কে দু’শ একর জমি প্রান্তিক চাষীদের জন্য সরকার হতে বন্দোবস্তী পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি উপকূলীয় অঞ্চলের বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কল্পে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই সময়ে পাঁচ কোটি টাকার বরাদ্দ মঞ্জুর করান। তাঁর কর্ম প্রচেষ্টআয় “বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ” প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি ১৯৫৬ সালে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান মরহুম মৌলভী ফরিদ আহমদ ও খতীব আজম মরহুম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের সহায়তায় কক্সবাজারে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ নামে বেসরকারী বিমান চলাচলের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ক্ষনজন্মা এই পুরুষ লেখক হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর লিখিত “কাবা শরীফের ইতিহাস” বইটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বইটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক তৃতীয় বারের মত প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি “মদীনা শরীফের ইতিকথা”, “মসজিদে নববী ও রওজা মোবারক”, “আদিতে মক্কাবাসী” ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। “যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম” নামে একটি গ্রন্থের পান্ডুলিপি প্রস্তুত রয়েছ প্রকাশের জন্য । এছাড়া তাঁর গবেষণা লব্ধ অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।
মরহুম চৌধুরীর ব্যক্তিগত পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা ১২ হাজারেরও অধিক। তিনি বাংলা, ইংরেজী, আরবী, উর্দু, ফারসী বিভিন্ন ভাষার দুষপ্রাপ্য ও মূল্যবান গ্রন্থের সংগ্রাহক। তাঁর সংগৃহীত বইগুলো তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে দান করে গেছেন।
সংস্কৃতি, খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। কক্সবাজার জেলা ষ্টেডিয়াম ও টেনিস কোর্ট প্রতিষ্ঠায় তিনি অবদান রেখেছেন। তিনি নামকরা খেলোয়াড় হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কক্সবাজার মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মরহুম চৌধুরী অত্র এলাকায় লোকজ সংস্কৃতি তথা জারি-সারি, পুঁথি, কাওয়ালী ও মারফতি সঙ্গীতের পৃষ্ঠাপোষক ছিলেন।
১৯৫২-এ ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বাড়ী ও আবাসিক হোটেল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্থানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এ কারণে তিনি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে নির্যাতিত ও দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। তিনি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।
জমিদার হিসেবে তিনি স্বীয় প্রজাদের সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন। আইনজীবী হিসাবে গরবী দুঃখী মানুষের বিনা পারিশ্রমিকে সুবিচার পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি সংস্কৃতিমনা, লেখক, সুবক্তা, রাজনীবিদ, সমাজসেবক, দক্ষ আইনজীবী হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি স্ত্রী, ৬ ছেলে, ৭ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুনগ্রাহী রেখে যান। মরহুমের গ্রামের বাড়ী পেকুয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর অগ্রজ সাবেক এম এল এ (১৯৪৫ সাল) আলহাজ্ব কবির আহমদ চৌধুরীর পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর পুত্র কন্যারা সুশিক্ষিত ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
প্রবীণ সাংবাদিক প্রিয়তোষ পাল পিন্টু দা’র বর্ণনা মতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিরোজ মিয়ার ‘দারুল আমান’ বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের যেমন ভূমিকা আছে। তেমনি কক্সবাজার জেলায় ইসলামের প্রচার-প্রসার আলেম ওলামাদের সম্মানে মেহমানদারী তাদের দুর্দিনে সহযোগিতায়ও রয়েছে এই পরিবারের অনন্য ভূমিকা। বলাযায় এই পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তেমনি আলেম ওলামা ও ইসলামের প্রচার প্রসারেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে।
চাচা ফিরোজ মিয়ার সময় দেখেছি দেশের প্রখ্যাত আলেম ওলামা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের কর্তারা কক্সবাজার ভ্রমণের সময় এ বাসায় মেহমান হয়ে আসতেন। খতীবে আজম মরহুম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদসহ দেশ- বিদেশের অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম, পীর মশায়েখ মেহমান হয়েছেন এই বাসায়। চাচা ফিরোজ মিয়া এবং চাচী কুলসুম নাহার চৌধুরী তাদের মেহমানদারী করেছেন নিঃসংকোচে। এখনো এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র আলহাজ্ব আলী হাচ্ছান চৌধুরী।
কক্সবাজারে বড় বড় ইসলামী সমাবেশ হলে অতিথিদের ওই বাসাতেই মেহমানদারী করা হয়ে থাকে। সমাবেশ আগত ওলামায়ে কেরাম দলে দলে ওখানেই আপ্যায়িত হন। দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব
দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন কক্সবাজার সফরকালে স্বপরিবারে
মানিক মিয়া ও হাচ্ছান ভাইয়ের মেহমান হয়েছেন একাধিকবার।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।