আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এবার আচমকা ধর্মঘটে নেমেছে সারা দেশের পরিবহন শ্রমিক সংগঠন। দক্ষিণাঞ্চলে চলা ধর্মঘট প্রত্যাহার ঘোষণার পরের দিনই রাজধানীসহ সারা দেশে এ ধর্মঘট ডাকায় ভোগান্তিতে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। সরকারের মন্ত্রীরা এ ধর্মঘটকে অযৌক্তিক বললেও গতকাল পর্যন্ত তা প্রত্যাহারের কোনো ঘোষণা আসেনি। আদালতে ঘাতক চালককে গুরুদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে কয়েকটি দাবিতে ধর্মঘট ডাকার কথা জানিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি কোনো পক্ষই। হঠাৎ ডাকা এই ধর্মঘটে গতকাল সকাল থেকে রাজধানীতে দুর্ভোগে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। সকালের দিকে কিছুটা যানবাহন চলাচল করলেও বিকালে সড়কে ছিল না কোনো গণপরিবহন। এছাড়া, টার্মিনালগুলো থেকে কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। কোনো যানবাহন টার্মিনালে প্রবেশও করতে পারেনি পরিবহন শ্রমিকদের বাধায়। এমনকি রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহন থেকে যাত্রী নামিয়ে দেয়ার চিত্রও দেখা গেছে কয়েকটি পয়েন্টে। এদিকে গতকাল রাত পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ধর্মঘটের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ঘোষণাও আসেনি তাদের পক্ষ থেকে। বিচ্ছিন্নভাবে বলা হয়েছে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। তবে কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকেই সুনির্দিষ্ট কোনো দাবি উত্থাপন করা হয়নি। দুটি দুর্ঘটনার ঘটনায় আদালতের দেয়া রায় পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে। এদিকে রাজধানীতে কিছু যানবাহন চলাচল করায় ওইসব পরিবহন শ্রমিক ও চালকরা বিভিন্নস্থানে মারধরের শিকার হয়েছেন। হেনস্তা করা হয়েছে যাত্রীদেরও। পরিবহন না থাকায় রাজধানীতে সাধারণ যাত্রীদের হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। এদিকে নগরে কিছু পরিবহন চলাচল করায় এর প্রতিবাদে মালিক সমিতির নেতাদের অফিসও ঘেরাও করে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাকর্মী ও চালক-শ্রমিকরা।
ধর্মঘটের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি মো. রুস্তম আলী খান মানবজমিনকে বলেন, সকালে খণ্ড খণ্ড কয়েকটি মিছিল নিয়ে চালক ও শ্রমিকরা আমার অফিস ঘেরাও করে কৈফিয়ত জানতে চায় কার ইন্ধনে নগরে গাড়ি চলছে। তিনি বলেন, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহতের মামলায় বাসচালকের যাবজ্জীবন সাজার রায় আসার পর শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। কয়েকদিন ধর্মঘট পালনের পর সোমবার রাতে আমরা আলোচনায় বসে সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছিলাম। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কর্মসূচি উঠিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মিটিংয়ের এক পর্যায়ে হঠাৎ শোনা গেল সাভারে এক দুর্ঘটনার মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর জজ কোর্টে এক ট্রাকচালকের ফাঁসির রায় হয়েছে। এরপরই শ্রমিকরা সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে গেছে। এখন আর কোনোভাবেই চালকদের বুঝাতে পারছি না আইন ও আদালতের জটিলতার বিষয়টি। তিনি আরো বলেন, কোনো চালক মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাতে রাজি না। টেলিভিশন টক শোতে কিছু লোকের উস্কানিমূলক কথার কারণে আমরা চালকদের এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে আমরা সবগুলো শ্রমিক সংগঠন ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি। কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় সেটা নিয়ে ভাবছি। বাংলাদেশ ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মো. মনির বলেন, মানিকগঞ্জের দুর্ঘটনার জন্য একজন চালকের যাবজ্জীবন ও সাভারের এক দুর্ঘটনার মামলায় ট্রাক ড্রাইভারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। আমরা কোনোভাবেই এটি মেনে নেবো না। অবশ্যই আদালতের রায় পরিবর্তন করতে হবে। আইনও পরিবর্তন করে শাস্তির বিধান কমাতে হবে। প্রশাসনসহ সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস না আসা পর্যন্ত আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, হঠাৎ করেই ধর্মঘটে মাঠ বেশি গরম হয়ে গেছে। আমরা শ্রমিকদের নিয়ে দিনভর মিটিং করছি। আলোচনা চালাচ্ছি। কিভাবে সমাধান করা যায় এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবো।
এদিকে সকাল থেকে রাজধানীর টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। ঢাকার বাইরে থেকেও কোনো গাড়ি টার্মিনালে আসেনি। শহরতলীতে চলাচলরত নগর পরিবহনগুলোও বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলে বাধা পেয়েছে। বিভিন্ন মোড়ে শ্রমিকদের ৫/৬ জনের গ্রুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি থামিয়ে চালকদের মারধর করতে দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ৭টার সময় সাতরাস্তা মোড়ে বলাকা পরিবহনের একটি বাস থামিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে ৫ জন যুবক। দরজা বন্ধ করে চালককে মারধর করতে থাকে। বলতে থাকে ‘কেন গাড়ি নামালি রাস্তায়। ধর্মঘট ডাকা হয়েছে জানিস না। তোর মালিক সমিতিকে বল আমরা পিটিয়েছি’। এক পর্যায়ে তেজগাঁও-বিজয় সরণী ফ্লাইওভার পর্যন্ত যাওয়ার পর যুবকরা নেমে যায় গাড়ি থেকে। পরে মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত গাড়ি গেলে ফিরিয়ে দেয়া হয় ওই গাড়িটিকে। গুলিস্তান থেকে মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত বিভিন্ন মোড়ে এমন ৫/৬ জনের গ্রুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নগর পরিবহন চলাচলে বাধা দিতে দেখা গেছে। বেলা ১১টার দিকে গাজীপুর থেকে আসা বলাকা পরিবহনের একটি বাসকে মহাখালী থেকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ওই বাসের চালক ফরিদ জানান, মহাখালী টার্মিনালের সামনে দিয়ে যেতে দিচ্ছে না। আমাদের যাইতে তো কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু টার্মিনালের সামনে দিয়া যাইতে দেয় না। টার্মিনালের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, পাবনার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন হামিদুর রহমান নামের যাত্রী। কিন্তু বাস না ছাড়ায় বিপাকে পড়েন তিনি। মোস্তাকিম বিল্লাহ নামের তিতুমীর কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৭টায় এসেছি টার্মিনালে। বাড়িতে সমস্যা থাকায় যেতে হবে। কিন্তু কোনো গাড়ি পাইনি। কুড়িল বাসস্ট্যান্ডে প্রায় দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর মতিঝিলে যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছিলেন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আমিনুল হক। কিন্তু মহাখালীতে নামিয়ে দেয়ায় খুবই বিরক্ত হন তিনি। বলেন, অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে বাসে উঠলাম। কিন্তু মাঝপথে এনে নামিয়ে দিলো। এখন বাসা বা অফিসে কিভাবে যাবো।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, নগর পরিবহন দুই একটা যা যাচ্ছে তা টার্মিনালের অনেক আগে থেকেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, বিভিন্ন রুটের গাড়ি টার্মিনালের ভেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাও সেখানে বাসের অপেক্ষায়। অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে বাসায় ফিরে গেলেও জরুরি প্রয়োজন থাকায় অনেককে পিকআপ ও সিএনজিতে চড়ে যাত্রা করতে দেখা গেছে। গাবতলী থেকেও কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ঢাকার বাইরে থেকে কোনো বাস টার্মিনালেও প্রবেশ করেনি। নগর পরিবহনগুলোকে গাবতলীর আগে মাজার রোড এলাকা থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, কিছু সময়ের জন্য গাবতলী এলাকায় সড়কের উপর বাস দাঁড় করে প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করতে দেখা গেছে। এদিকে সন্ধ্যার দিকে অফিস ফেরত কর্মজীবীদের হেঁটে হেঁটে যার যার গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। কেউ কেউ যানবাহনের জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে অপেক্ষা করছিলেন। সন্ধ্যার দিকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অপেক্ষমাণ যাত্রী ছাড়া কোনো যানবাহনের দেখা মিলেনি।
এদিকে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডাকা দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গতকাল সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, দেশবরেণ্য খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫ জনকে সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যার দায়ে বাসচালক জামির হোসেনকে মানিকগঞ্জের আদালত রায় দিয়েছে। এর প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় এবং গতকাল থেকে শরিয়তপুরে ধর্মঘট পালন করছিল। এর মধ্যে সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার এক আদালত ট্রাকচালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় দেয়। এর প্রতিবাদে গতকাল সকাল থেকে সারাদেশে আকস্মিক পরিবহন ধর্মঘটে দেশের কোটি কোটি যাত্রীদের জিম্মি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই ধর্মঘট আদালত অবমাননাকর, অযৌক্তিক ও গণবিরোধী। নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিবর্তে এ পরিবহন ধর্মঘট পেশীশক্তি প্রদর্শন করে জনগণকে জিম্মি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার একটি সুগভীর নীলনকশা।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।