কক্সবাজার সময় ডেস্কঃ টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিস্থিতি আরো অবনতির আশঙ্কা করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে একা পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও কঠিন বলে মনে করছে তারা। এ অবস্থায় সহায়তার জন্য ২০টি মেডিক্যাল টিম পাঠাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সঙ্গে এক লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনায়। গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টিম। তাদের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, আশ্রিতদের মধ্যে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়েছে তাদের ভেতরে গতকাল পর্যন্ত সর্বাধিক ২৯ শতাংশের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। ১২ শতাংশের রয়েছে ডায়রিয়া। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগের উপসর্গ পাচ্ছে ওই টিম। গতকাল কক্সবাজারে অবস্থানরত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে ওই তথ্য জানিয়ে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগে থেকেই আমাদের নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে।
সবার সহায়তা নিয়েই এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ৩৮টি মোবাইল মেডিক্যাল টিম কাজ করে চলছে। টিম ঘুরে ঘুরে রাত-দিন চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ডা. পুনম ক্ষেত্রপল বলেন, ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত চার লাখ ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার এলাকায় এসেছে। তার মধ্যে তিন লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ এখনো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, যে যার মতো বসতিতে অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় তাদের মধ্যে নানা ধরনের রোগের প্রার্দুভাব ছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও বড় উদ্বেগজনক পরিস্থিতির তৈরি করেছে, যা মোকাবেলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্য সংস্থাগুলোর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেড় লাখ শিশুকে টিকা দেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানোর আগেই অবশ্য স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের মতে, রোহিঙ্গারা যেভাবে রোদে পুড়ে, পানিতে ভেসে, বন-জঙ্গল ভেঙে আসছে, তাতে তাদের নানা রোগের ঝুঁকি রয়েছে। কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়ার মতো রোগের প্রকোপ আশ্রিতদের মধ্যে ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। তাই জরুরি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াসহ প্রয়োজন অনুসারে রোগ নির্ণয়ে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শিশুদের অপুষ্টি রোধে জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গত সোমবার নিজ মন্ত্রণালয়ে এক অনুষ্ঠানে জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কয়েক হাজার প্রসূতি নারী রয়েছেন। তাঁদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করেছে মন্ত্রণালয়। অন্য রোহিঙ্গাদেরও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকায় মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০-তে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে। ওই অঞ্চলের ৩০টি কমিউনিটি ক্লিনিকেরও সংস্কার করা হচ্ছে শরণার্থীদের চাপ সামলাতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, উদ্বাস্তুদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নানা ধরনের রোগের ঝুঁকি থাকে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন তাদের স্বাস্থ্যসম্মত থাকার ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা। তবেই অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টি শুরু থেকেই আমাদের নজরে এসেছে। সে অনুসারে শুরু থেকেই মেডিক্যাল টিম কাজ শুরু করেছে। রোগ প্রতিরোধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এসব কাজে আমাদের সহায়তা করছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার শিশুকে টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এসব পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্যগত নানা বিপর্যয় দেখা দেয়। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা যতটা সম্ভব কার্যকর করা না গেলে যেকোনো সময় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। আমরা এসব বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করেছি। স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরাও পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আশ্রয়কেন্দ্রের ১২টি ব্লকে আমরা স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। ’
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।