মরিচ্যা থেকে আসা মর্জিনা বেগম হাজত খানার সামনে মুখে হাত দিয়ে একটি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে অসহায় নারীর মতো বসে আছেন। তার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার ছেলে আলমগীর একটি মামলার আসামি হয়ে জেল খাটছেন। গত ১৪ মার্চ মঙ্গলবার তার কোর্টে শুনানি ছিল। ছেলেকে দেখার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে আসার সময় অভাবী স্বামীর কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে এসেছি। এখন বেলা সাড়ে ৩টা। তার ছেলে এখনও কোর্ট হাজতে না খেয়ে রয়েছে, তাই দোকান থেকে ৩০ টাকার রুটি ও কলা কিনেছি। কিন্তু রুটি-কলা দিতে হলে ওদেরকে (কোর্ট হাজতে দায়িত্বরত পুলিশ) ১০০ টাকা দাবি করছে। কিন্তু আমার কাছে অতো টাকা নেই বলে রুটি-কলা ছেলেকে দিয়ে খাওয়াচ্ছি, অপর বড় ছেলেকে আর দিতে পারলাম না।’ এমন একজন অসহায় নারীর মুখের অভিযোগ শুনতে শুনতে দেখা যায়, অসংখ্য লোকজন কক্সবাজারের নামী-দামি হোটেলের প্যাকেটে করে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য সামগ্রী, কোমল পানীয়, ভাল ব্রান্ডের সিগারেট নিয়ে সরাসরি হাজত খানার সামনে যাচ্ছেন। এ সময় হাজত খানার দায়িত্বে থাকা পুলিশের হাবিলদার এগিয়ে আসতেই পকেট থেকে হাজতখানার সামনে ব্যারাকের ভিতর গিয়ে রেট অনুযায়ী ঘুষের টাকা দিয়ে ভিতরে চলে যায়।
এভাবেই কক্সবাজার আদালতে কোর্ট পুলিশ দীর্ঘ দিন যাবত প্রকাশ্য বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য করে চলেছে। তবে, অজ্ঞাত কারণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ। বিচার প্রার্থীদের জামিন মঞ্জুরের কাগজ জেলখানায় পৌঁছানো, কোর্ট হাজতখানায় আসামিদের সাথে সাক্ষাৎ, খাবার দেওয়া, মামলা সংক্রান্ত নথিপত্রের ফটোকপিসহ সকলক্ষেত্রে জনগণকে জিম্মি করে ঘুষ বাণিজ্য করছে পুলিশ। কোর্টে দায়িত্বরত কনস্টেবল থেকে শুরু করে পরিদর্শক পর্যন্ত সবাই প্রকাশ্যে এ দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানে না বলে দাবী করেছেন। তারা প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা ধান্ধা করে কোর্ট পরিদর্শকসহ সবাই মিলে ভাগবাটোয়ারা করে আসছে।
কোর্ট পুলিশের দায়িত্বরত নিম্ন পদস্থ থেকে উচ্চ পদস্থ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে চলছে। আবার দাগী আসামী, ভিআইপি ইয়াবা ব্যবসায়ী ও শীর্ষ মানবপাচারকারীদের আলাদা বৈঠক বা তাদের আতœীয় স্বজনদের দেখা করার সুযোগ করে দেয় বলেও জানান অনেকে। আর টাকা না পেলে নানাভাবে হয়রানি করে বলে জানান ভুক্তভোগী অনেক লোকজন ও আদালতে কর্মরত আইনজীবীরা।
চকরিয়া বড়ইতলী থেকে আসা ছৈয়দ হোসেন জানান, সে গতকাল সকাল দশ টা থেকে কোর্টে এসে তার ভাইয়ের জন্য বাড়ির রান্না করা খাবার নিয়ে বসে আছে অনেক্ষন ধরে। পরে তার ভাই পুলিশের ভ্যান করে আসার সাথে সাথে কোর্টে দায়িত্বরত একজন পুলিশের কাছে বললে তার কাছ থেকে ৫ শত টাকা দাবী করে। পরে তাকে সর্বোচ্চ তিন শত টাকা দিতে চাইলে শুধুই খাবার গুলো সেলঘরে ডুকিয়ে দিতে পারবে বলে টাকা নেয়। আবার সে তার ভাইয়ের সাথে আলাদা কথা বলার জন্য দুই শত টাকা দিয়ে দশ মিনিট কথা বলার পর তাকে বের করে দেয়। এভাবে আরো শত শত মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারপরেও বাধ্য হয়ে স্বজনদের সাথে দেখা করতে হয়। তার কারনে কাউকে মুখ খুলে কিছু বলতে পারেনা। সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার প্রত্যান্ত এলাকা থেকে শত শত মানুষ কোর্টের পাশে টাকা অভাবে দেখা ঘরে ডুকে তাদের স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারেনা। বসে থাকে বারান্দায় দিনক্ষন কখন রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যাবে। আর ইয়াবা ও মানবপাচারকারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা তাদের আতœীয় স্বজনরা আসলে জামাই আদরে মোটাংকের মাধ্যমে নিজের বাড়ির মত পাশে বসে আড্ডা দিতে পারেন এমনকি ঘুমও যেতে পারেন।
কোর্ট পুলিশ অফিসের বারান্দায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভীড় লেগেই থাকে। এর মধ্যে টেকনাফের শাহ আলম ও মুন্নী বলেন, ছেলের সাথে দেখা করে ভাত দিতে এসেছিলাম। প্রথমে ৭০০ টাকা পরে ভাত দিতে আরো ৩০০ টাকা দিয়েছি। এভাবে অসংখ্য ভুক্তভোগীদের তীব্র ক্ষোভ কোর্ট পুলিশের বিরুদ্ধে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জিআর মামলার ফটোকপি ১০০ টাকা, মামলা ফাইলিংয়ের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ টাকা, সিআর মামলার ফটোকপি নিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, বেলবন্ডপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা, জামিনপ্রাপ্ত আসামি কোর্ট থেকে ছাড়াতে ১০০ টাকা, ১৬৪ ধারার ফটোকপি তুলতে ২০০ টাকা, ৩৪ ধারার মামলার আসামির জামিনের ক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে অর্থ আদায়, রিকল সাক্ষর করতে ১০০ টাকা, কোর্ট হাজত খানায় আসামির সাথে দেখা করতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। এছাড়া একটু বিশেষ ভাবে দেখা করা কিংবা কথা বলার সুযোগ পেতে হাজত খানার দায়িত্বরত পুলিশের হাবিলদারের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে হয়। আর খাবার দিতে ১০০/২০০ টাকা, উকালতনামায় আসামির সাক্ষর করাতে হলে ২০ টাকা করে প্রকাশ্য ঘুষ নেয়া হচ্ছে। এই টাকা আদায় ও বন্টনের দায়িত্বে রয়েছেন কোর্ট পুলিশের আবু সুফিয়ান নামের সদ্য প্রমোশন পাওয়া এক কনস্টেবল।
দীর্ঘদিন ধরে কোর্ট পুলিশের ওসির কক্ষের দু’পার্শ্বেই প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য চলছে। তবে কেউ এর প্রতিবাদ না করে ম্যানেজ ফর্মুলায় তুষ্ঠ থাকেন বলে জানা গেছে।
প্রতিদিন সদর জিআরওতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় হয়। আর এ টাকা থেকে কোর্ট পুলিশ পরিদর্শকসহ বিভিন্ন জনকে বন্টন করতে হয়। অন্যদিকে, পুলিশ কনস্টেবল নুরুল হক, আলতাজ, আলা উদ্দিনসহ কোর্টে দায়িত্বরত জিআরও পুলিশ কনস্টেবলরা একই ভাবে রেট অনুযায়ী ঘুষ বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছেন। আর প্রতিদিনের ঘুষের আয় খাতায় নোট করে হিসেব রাখেন, কনস্টেবল ফরিদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আইনজীবী সহকারী বলেন, কোর্ট পুলিশের বেপরোয়া ঘুষ দুর্নীতিতে ভুক্তভোগীরা সকলেই চরম ক্ষুব্ধ কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তারা আরও জানান, কোর্টের জিআরও ও কনস্টেবলদের সাথে মাঝে মধ্যে ঘুষ আদায় নিয়ে আইনজীবী সহকারীদের বাকবিতন্ডা হয়ে থাকে। কারণ আগে কোন নথি বা চার্জশিট তুলতে যা দিতাম এখন তারও রেট বাড়িয়েছে। এমনকি আদালত চলাকালীন সময়ে হাজিরা দিতে আসা আসামি কিংবা রিমান্ড শুনানি হলেও কোর্ট পুলিশদের টাকা দিতে হয়। তাদের মতে গোটা আদালত অঙ্গণে এক ধরনের নৈরাজ্য কায়েম করেছে চলছে পুলিশ প্রশাসন। তবে কোর্ট সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মতে, যেসব বড় বড় ক্যাডার, ইয়াবা ব্যবসায়ী-মানবপাচারকারী ও দাগী আসামিরা জেলে রয়েছে তাদের কোর্টের দিন হাজতখানায় আনা হলে বাহিরের নেতা ও পরিবারের সাথে খোলামেলা পরিবেশে দেখা ও গোপন কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের লেনদেন হয়ে থাকে। তবে বেশি খারাপ লাগে কিছু নেহায়েত গরিব মানুষ অনেক দূর থেকে আসে তাদের উপর জুলুম করে ওরা। বিশেষ করে জামিনের কাগজ পৌঁছাতে যা করে তা বলার মত না। অনেক আসামী আছে মানবিক কারণে আমরাও টাকা নিনা। কিন্তু তাদের কাছে ছাড় নেই। মোটকথা কোর্ট পুলিশ বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি করছে। তাদের লাগাম টেনে ধরা দরকার।
এই ওয়েব সাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।